08 March 2017

মুর্শিদাবাদের নদনদী ও চাঁদ সওদাগরের যাত্রাপথ

রাজকুমার সেখ

ভাণ্ডারদহ বিল (Bhandardah Bil)               ছবি: দীননাথ মণ্ডল 

 মুর্শিদাবাদ জেলা, এই অঞ্চলটি হচ্ছে নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থিত উত্তরে পার্বত্য অঞ্চলপশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ এই সমভূমিতে পড়ে এই জেলা হচ্ছে বাগড়ি অঞ্চল। ভাগিরথী নদী মুর্শিদাবাদ জেলাকে দু’ভাগে ভাগ করেছেপূর্বদিকে পদ্মা ও ভাগিরথী ‘বাগড়ি’ অঞ্চল ও ভাগিরথীর পশ্চিমদিকে ময়ূরাক্ষী ও ভাগিরথী অববাহিকা ‘রাঢ়’ অঞ্চলতবে এই জেলার বেশি অংশটাই বাগড়ি অঞ্চলআর বাকি অংশটুকু রাঢ় ভূমিতে মিশে 

     বাগড়ি অঞ্চল : বহরমপুর, লালবাগ, ডোমকল, জিয়াগঞ্জ, জঙ্গিপুর, আমতলা, বেলডাঙ্গা, লালগোলা, ভগবানগোলা, পাটকাবাড়ি, হরিহরপাড়া, প্রভৃতি শহর ও উপশহরগুলি হচ্ছে বাগড়ি ভূমিতে মিশে।মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর পূর্বে গঙ্গা ও পদ্মা প্রবাহিত। 
    নদীর অবস্থান- মুর্শিদাবাদ জেলার নদী সংখ্যা বহুগোটা জেলাতে বহু প্রাচীন যুগ থেকে অনেক নদীর অবস্থান লক্ষ্য করা যায়হয়তো সময়ের ধারাতে কেউ কেউ দিক পরিবর্তন করেছেযদিও সেই সব নদীর অবস্থা করুণবেশিরভাগ নদীই তার গতিবেগ থাকেনাস্রোত ধীর স্থিরদুর্বলবর্ষায় কিছুটা বোঝা যায় নদীর রূপ
   এই সব নদীগুলি আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছেবেশিরভাগ নদীই ভরাট করে ইমারত তৈরী হচ্ছেজলাশয়গুলি হারিয়ে যাচ্ছেজল ধারনের জায়গাগুলি আজ বড় বড় অট্টালিকাএই সব নদী গুলোর কথা আগামী প্রজন্ম জানবে না !
   মুর্শিদাবাদের বহু জলাশয় নদী দীর্ঘকাল হতে পরে আছেএদের কোন সংস্কার হয়নিঅথচ এই সব নদীর একটি নাম আছে; আছে পুরোনো ইতিহাসএই নদীগুলিই বহু মানুষের অন্ন যোগান দেয়অবশ্য সংস্কার না হওয়ায় এই নদী সুনাম হারিয়েছে
   মুর্শিদাবাদ জেলার নদী একটি বড় সম্পদএই নদীগুলি যদি সংস্কার করেন সরকার তাহলে বহু মানুষের জীবিকা হতে পারে
   নদী বলতে এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল- ভাগিরথী, পদ্মা,জলঙ্গী, ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, ময়ুরাক্ষী, শিয়ালমারী, কুয়ো, বাবলা প্রভৃতি
   আর যে সব নদী বহুদিন আগে স্রোত হারিয়ে বুকে পলি জমে জমে নদীগুলি এক একটা অংশে ভাগ হয়ে গেছে সেগুলি হল- হিজুলি, ডুমনি, চালতা, খালকাঁদি, কাটিগঙ্গা, সুজাপুর বিল, রামপাড়া বিল, ভান্ডারদহ, রাঙামাটি চাঁদপাড়া বিল প্রভৃতি
   এই জলাশয়গুলি এক সময় নদী-ই ছিলকালের আবহমান গতিতে এরা আজ ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে গেছেযদিও এদের দৈর্ঘ্য দেখলে মনে হবে এক একটি বিরাট নদী এক সময় এই জলাগুলি নদীর এক একটি অংশ ছিল
   এই নদীর দু’পাড়ে বহু যুগ আগে বহু জনপদ গড়ে উঠেছিলযদিও এই সব নদী পাড়ে খুঁজলে পাওয়া যায় সেই নিদর্শনএবং জন শ্রুতিতে শোনা যায় প্রাচীন গল্প


    প্রাচীন ডুমনী : ডুমনী বিলঅবশ্য একে ‘বিল’ বললে ভুল বলা হবেএটি একটি প্রাচীন নদী-ইএই নদী ভান্ডারদহ থেকে উৎপত্তি হয়ে বয়ে গেছে একদম দক্ষিণ মুখো হয়ে বেলডাঙ্গার ওপর দিয়ে বহু দূরেএক সময় এই নদীতে তীব্র স্রোত ছিলএর প্রাচীন একটি ইতিহাস আছে
    এই নদীকে কেন্দ্র করে বহু চাষি জীবন ধারণ করেধান চাষের জন্য এই নদীর জল ব্যবহার করে চাষিরাঅথচ এই নদী সেই প্রাচীন যুগে নব যৌবনা ছিলএর স্রোতে ভেসে আসতো বজরা নিয়ে বহু মাঝি-মাল্লার দল এর পাড়েই গড়ে উঠেছিল ইংরেজদের কুঠিএই নদীর দক্ষিণ মুখো বেগমবাটি বন্দর গড়ে ওঠে ওই সময়তাই বহু মানুষ আসত ব্যবসা বাণিজ্য করতে তারও বহু যুগ আগে চাঁদ সওদাগর এসেছিলেন তাঁর মাঝি-মাল্লা নিয়েএই বেগমবাটি বন্দরে বেঁধেছিলেন বজরা অবশ্য এটা জনশ্রুতি
    তবে এখানে সাহেবদের কুঠি ছিল তার নিদর্শন পাওয়া যায়
    এই নদীর দু-পাড়ে রেশম চাষ হতোএই অঞ্চলে রেশমের কদর ছিল বলেই দূর-দূরান্ত থেকে নদী পথে আসত বাণিজ্য করতে রেশমের কুঠিগুলো এখনও বিরাজমানইংরেজ ও ফরাসিরা আসত এখানেএখানে তৎকালীন সময়ে নীল চাষও করত এই অঞ্চলগুলিতে এখনও যদি খোঁজা যায় তাহলে নীলকুঠির ভাঙ্গা অংশগুলি পাওয়া যাবে
    আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে এই নদীর হারিয়ে যাওয়া একটি অংশে, জায়গাটি হচ্ছে বেলডাঙ্গা মাঝপাড়ার কাছাকাছি দাসদের বাড়ি করবার সময় পাওয়া যায় এই নদীর পাড়ের মহাশ্মশানমাটি খুঁড়ে ওঠে আসে শ্মশানের পোড়া কাঠ, হাড় আরও অনেক কিছু
   যদিও নদীর এই অংশটি বোঝা যায় না যে এখানে এক সময় এক বিশাল নদী ছিলতবে অনুমান করা যায় যে এর পাশ দিয়ে ডুমনী নদী বয়ে যেততাহলে এই থেকে বোঝা যায় যে এই পথ দিয়েই হয়তো চাঁদ সওদাগর-এর আগমন ঘটেছিল
   বেগমবাটির বন্দর-এর টানে বহু মানুষের আগমন ঘটেছিল সেই সময়বহু মানুষের পদধূলি পড়েছে এখানে রেশমকুঠির নিদর্শন এখনো আছে
    বাণিজ্য শুধু এই পথেই চলত নাবাণিজ্য চলত ভৈরব নদীতেএই নদীর দু’পাড়ে গড়ে উঠেছিল রেশম শিল্পও বিভিন্ন হস্ত শিল্পেরসেই সময় মুর্শিদাবাদে প্রচুর পরিমাণে মুক্তোও চাষ হতোএর কদর ছিল বিদেশে
    কাশিম বাজার যেমন ছিল এক বিরাট জনপদনদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই জনপদশাহাজান বাদশার প্রধান সেনাপতি কাশিম খাঁর নামে নামাঙ্কিত হয় ‘কাশিম বাজার’ 
    এক কথায় মুর্শিদাবাদে যা কিছু গড়ে উঠেছিল সেই সময় এই নদীগুলিকে কেন্দ্র করেকালের আবহমান গতিতে আজ তা ধ্বংসশুধু স্মৃতি রেখে গেছে এখানকার মাটিতেহয়তো দাগ খুঁজলে পাওয়া যাবে সেই সব পুরোনো স্মৃতি  ধূসর হয়ে আছে সব
    মুর্শিদাবাদ আছে মুর্শিদাবাদেই
    শুধু নদীর সেই বিশাল ঢেউ নেইএখন শ্যাওলা জমে তার বুকেসবুজ আবার ফলবে এই আশায়..., কালো জলে একদিন আবার ঢেউ উঠবে তার উজ্জ্বল স্মৃতি নিয়ে

আরও পড়ুন : মুর্শিদাবাদের একটি অপ্রকাশিত ইতিহাস

----------


1 comment:

  1. আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ যেন এই‌ নদীটিকে আবার আগের রূপ ফিরিয়ে দেয়। আবার যেন জন্মায় বিশাল বিশাল ঢেউ আর সবুজ প্রকৃতি।। আমিন।।

    ReplyDelete