রাজকুমার
সেখ
মুর্শিদাবাদ জেলা, এই অঞ্চলটি হচ্ছে নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থিত। উত্তরে পার্বত্য অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ এই
সমভূমিতে পড়ে। এই জেলা হচ্ছে বাগড়ি অঞ্চল। ভাগিরথী নদী মুর্শিদাবাদ জেলাকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। পূর্বদিকে পদ্মা ও ভাগিরথী ‘বাগড়ি’ অঞ্চল ও ভাগিরথীর পশ্চিমদিকে ময়ূরাক্ষী ও
ভাগিরথী অববাহিকা ‘রাঢ়’ অঞ্চল। তবে এই জেলার বেশি অংশটাই বাগড়ি অঞ্চল। আর বাকি অংশটুকু রাঢ় ভূমিতে মিশে।
বাগড়ি অঞ্চল : বহরমপুর, লালবাগ, ডোমকল, জিয়াগঞ্জ,
জঙ্গিপুর, আমতলা, বেলডাঙ্গা, লালগোলা, ভগবানগোলা, পাটকাবাড়ি, হরিহরপাড়া, প্রভৃতি শহর
ও উপশহরগুলি হচ্ছে বাগড়ি ভূমিতে মিশে।মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর পূর্বে গঙ্গা ও পদ্মা
প্রবাহিত।
নদীর অবস্থান- মুর্শিদাবাদ
জেলার নদী সংখ্যা বহু। গোটা জেলাতে বহু প্রাচীন যুগ থেকে অনেক নদীর অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। হয়তো সময়ের ধারাতে কেউ কেউ দিক পরিবর্তন করেছে। যদিও সেই সব নদীর অবস্থা করুণ। বেশিরভাগ নদীই তার গতিবেগ থাকেনা। স্রোত ধীর স্থির। দুর্বল। বর্ষায় কিছুটা বোঝা যায় নদীর রূপ।
এই সব নদীগুলি আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ নদীই ভরাট করে ইমারত তৈরী হচ্ছে। জলাশয়গুলি হারিয়ে যাচ্ছে। জল ধারনের জায়গাগুলি আজ বড় বড় অট্টালিকা। এই সব নদী গুলোর কথা আগামী প্রজন্ম জানবে না !
মুর্শিদাবাদের বহু জলাশয় নদী দীর্ঘকাল হতে পরে আছে। এদের কোন সংস্কার হয়নি। অথচ এই সব নদীর একটি নাম আছে; আছে পুরোনো ইতিহাস। এই নদীগুলিই বহু মানুষের অন্ন যোগান দেয়। অবশ্য সংস্কার না হওয়ায় এই নদী সুনাম হারিয়েছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার নদী একটি বড় সম্পদ। এই নদীগুলি যদি সংস্কার করেন সরকার তাহলে বহু মানুষের জীবিকা হতে পারে।
নদী বলতে এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল- ভাগিরথী, পদ্মা,জলঙ্গী, ব্রাহ্মণী,
দ্বারকা, ময়ুরাক্ষী, শিয়ালমারী, কুয়ো, বাবলা প্রভৃতি।
আর যে সব নদী বহুদিন আগে স্রোত হারিয়ে বুকে পলি জমে জমে নদীগুলি এক একটা অংশে
ভাগ হয়ে গেছে সেগুলি হল- হিজুলি, ডুমনি, চালতা, খালকাঁদি, কাটিগঙ্গা, সুজাপুর বিল,
রামপাড়া বিল, ভান্ডারদহ, রাঙামাটি চাঁদপাড়া বিল প্রভৃতি।
এই জলাশয়গুলি এক সময় নদী-ই ছিল। কালের আবহমান গতিতে এরা আজ ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে গেছে। যদিও এদের দৈর্ঘ্য দেখলে মনে হবে এক একটি বিরাট নদী। এক সময় এই জলাগুলি নদীর এক একটি অংশ ছিল।
এই নদীর দু’পাড়ে বহু যুগ আগে বহু জনপদ গড়ে উঠেছিল। যদিও এই সব নদী পাড়ে খুঁজলে পাওয়া যায় সেই নিদর্শন। এবং জন শ্রুতিতে শোনা যায় প্রাচীন গল্প।
প্রাচীন ডুমনী : ডুমনী বিল। অবশ্য একে ‘বিল’ বললে ভুল বলা হবে। এটি একটি প্রাচীন নদী-ই। এই নদী ভান্ডারদহ থেকে উৎপত্তি হয়ে বয়ে গেছে একদম দক্ষিণ মুখো হয়ে বেলডাঙ্গার
ওপর দিয়ে বহু দূরে। এক সময় এই নদীতে তীব্র স্রোত ছিল। এর প্রাচীন একটি ইতিহাস আছে।
এই নদীকে কেন্দ্র করে বহু চাষি জীবন ধারণ করে। ধান চাষের জন্য এই নদীর জল ব্যবহার করে চাষিরা। অথচ এই নদী সেই প্রাচীন যুগে নব যৌবনা ছিল। এর স্রোতে ভেসে আসতো বজরা নিয়ে বহু মাঝি-মাল্লার দল। এর পাড়েই গড়ে উঠেছিল ইংরেজদের কুঠি। এই নদীর দক্ষিণ মুখো বেগমবাটি বন্দর গড়ে ওঠে ওই সময়। তাই বহু মানুষ আসত ব্যবসা বাণিজ্য করতে। তারও বহু যুগ আগে চাঁদ সওদাগর এসেছিলেন তাঁর মাঝি-মাল্লা নিয়ে। এই বেগমবাটি বন্দরে বেঁধেছিলেন বজরা। অবশ্য এটা জনশ্রুতি।
তবে এখানে সাহেবদের কুঠি ছিল তার নিদর্শন পাওয়া যায়।
এই নদীর দু-পাড়ে রেশম চাষ হতো। এই অঞ্চলে রেশমের কদর ছিল বলেই দূর-দূরান্ত থেকে নদী পথে আসত বাণিজ্য করতে। রেশমের কুঠিগুলো এখনও বিরাজমান। ইংরেজ ও ফরাসিরা আসত এখানে। এখানে তৎকালীন সময়ে নীল চাষও করত এই অঞ্চলগুলিতে। এখনও যদি খোঁজা যায় তাহলে নীলকুঠির ভাঙ্গা অংশগুলি পাওয়া যাবে।
আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে এই নদীর
হারিয়ে যাওয়া একটি অংশে, জায়গাটি হচ্ছে বেলডাঙ্গা মাঝপাড়ার কাছাকাছি দাসদের বাড়ি
করবার সময় পাওয়া যায় এই নদীর পাড়ের মহাশ্মশান। মাটি খুঁড়ে ওঠে আসে শ্মশানের পোড়া কাঠ, হাড় আরও অনেক কিছু।
যদিও নদীর এই অংশটি বোঝা যায় না যে এখানে এক সময় এক বিশাল নদী ছিল। তবে অনুমান করা যায় যে এর পাশ দিয়ে ডুমনী নদী বয়ে যেত। তাহলে এই থেকে বোঝা যায় যে এই পথ দিয়েই হয়তো চাঁদ সওদাগর-এর আগমন ঘটেছিল।
বেগমবাটির বন্দর-এর টানে বহু মানুষের আগমন ঘটেছিল সেই সময়। বহু মানুষের পদধূলি পড়েছে এখানে। রেশমকুঠির নিদর্শন এখনো আছে।
বাণিজ্য শুধু এই পথেই চলত না। বাণিজ্য চলত ভৈরব নদীতে। এই নদীর দু’পাড়ে গড়ে উঠেছিল রেশম শিল্প। ও বিভিন্ন হস্ত শিল্পের। সেই সময় মুর্শিদাবাদে প্রচুর পরিমাণে মুক্তোও চাষ হতো। এর কদর ছিল বিদেশে।
কাশিম বাজার যেমন ছিল এক বিরাট জনপদ। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই জনপদ। শাহাজান বাদশার প্রধান সেনাপতি কাশিম খাঁর নামে নামাঙ্কিত হয় ‘কাশিম বাজার’।
এক কথায় মুর্শিদাবাদে যা কিছু গড়ে উঠেছিল সেই সময় এই নদীগুলিকে কেন্দ্র করে। কালের আবহমান গতিতে আজ তা ধ্বংস। শুধু স্মৃতি রেখে গেছে এখানকার মাটিতে। হয়তো দাগ খুঁজলে পাওয়া যাবে সেই সব পুরোনো স্মৃতি। ধূসর হয়ে আছে সব।
মুর্শিদাবাদ আছে মুর্শিদাবাদেই।
শুধু নদীর সেই বিশাল ঢেউ নেই। এখন শ্যাওলা জমে তার বুকে। সবুজ আবার ফলবে এই আশায়..., কালো জলে একদিন আবার ঢেউ উঠবে তার উজ্জ্বল স্মৃতি
নিয়ে।
আরও পড়ুন : মুর্শিদাবাদের একটি অপ্রকাশিত ইতিহাস
আরও পড়ুন : মুর্শিদাবাদের একটি অপ্রকাশিত ইতিহাস
----------


আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ যেন এই নদীটিকে আবার আগের রূপ ফিরিয়ে দেয়। আবার যেন জন্মায় বিশাল বিশাল ঢেউ আর সবুজ প্রকৃতি।। আমিন।।
ReplyDelete