মুকতাদির
হোসেন মোল্লা II
দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে সে অনেক দিনের কথা, তা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আবার
কিছু ঘটনা যা লোক চক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। এখনও অনেক বয়স্ক মানুষ বেঁচে আছেন,
তাদের স্মৃতির মণিকোঠায় সঞ্চিত আছে সেসব কিছু ঘটনা। আবার অনেক ঘটনা ইতিহাসের পাতায় ঠাই পাইনি, স্মৃতি হিসাবে যা এখনও বর্তমান।
কিছুদিন পর তাও জলের গভীরে তলিয়ে যাবে।
মুর্শিদাবাদের ভাগিরথী নদী দিয়ে
অনেক জল বয়ে চলেছে, কত টন, কত গ্যালন কে বা তার হিসাব রাখে। এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল
বহরমপুর ভাগিরথী নদীর পূর্ব পাড়ে গোরাবাজার শ্মশান ঘাটের কিছু উত্তরে কুমার
হোস্টেলে- যার পূর্ব নাম ছিল সার্কিট হাউস। ব্রিটিশ আমলে ত্রিতল বিশিষ্ট সার্কিট
হাউস চলত চরম ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে। এই সার্কিট হাউসের ময়দানে ১৯৩৭ সালের অক্টোবর
মাসে ঘটেছিলো এক ঐতিহাসিক সমাবেশ। বর্তমানে সার্কিট হাউসের ঘরটি জীর্ণদশা। ঘর বললে
ভুল বলা হবে- খন্দহর বলা যেতে পারে। পুরনো সার্কিট হাউসকে জড়িয়ে গজিয়ে উঠেছে
লতা-গুল্ম-অশ্বত্থ গাছের শেকড়। ভাঙ্গা ইঁটের কঙ্কালসার দেহের পাঁজরে কান পাতলে ইতিহাসের ফিসফিস কথা শোনা যায়।
একদিন এই মাঠেই ঘটেছিল সেই ঐতিহাসিক সম্মেলন যার নাম দেওয়া হয়েছিল প্রাদেশিক
মোসলেম কনফারেন্স। চলেছিল ২৩ ও ২৪ অক্টোবর দু’দিন ধরে। পুরাতন সার্কিট হাউস জুড়ে
তখন ছিল চরম ব্যস্ততা। তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কৃপালিনী সাহেব আরো ব্যস্ত
ছিলেন, কারণ সম্মেলনে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেখভাল ও থাকা খাওয়ার দায়িত্ব
তিনি নিজের হাতেই সার্কিট হাউসে করতে চান। এই সভার সভাপতিত্বের আসন গ্রহন করেছিলেন
তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বনামধন্য ব্যারিস্টার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মিষ্টার
মহম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব। সঙ্গে এসেছিলেন তার ভগ্নী মিস ফাতিমা জিন্নাহ। উপস্থিত
হয়েছিলেন তৎকালীন বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) ফজলুল হক সাহেব এবং তার মন্ত্রী
পরিষদ। এছাড়া বিশিষ্ট অতিথিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিঃ নুরুদ্দিন সাহেব ও তার
সহধর্মিণী এবং বিশিষ্ট মহিলাগণ সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেখ
ভালের দায়িত্বে ছিলেন কাশিমবাজার রাজ শ্রীশ নন্দী মহাশয়, নবাব মোশাররফ হোসান, নবাব
হাবিবুল্লাহ খান বাহাদুর (ঢাকা), সহিদ সারওয়াদি বার এ্যটল ও খাজা নাজিমুদ্দিন
সাহেব এবং বাংলার প্রধান দুই নায়ক মওলানা মহম্মদ আকরাম খাঁ সাহেব। হুগলীর শিয়া
সম্প্রদায়ের নেতা মিঃ নুরুদ্দিন সাহেব, খান বাহাদুর সরফুদ্দিন ও ডাক্তার
শাহিদুল্লাহ প্রমুখ নাম করা ব্যক্তিত্ব।
বাংলার বিখ্যাত গায়ক আব্বাস
উদ্দিন সাহেব ইসলামী সংগীত দ্বারা এই বিরাট সম্মেলনকে অনুপ্রাণিত করেন। প্রায় ১৭
থেকে ১৮ হাজার মানুষের সমাগম সত্ত্বেও সুশৃঙ্খল ভাবে এই সভার কার্যপ্রণালী
পরিচালিত হয়। প্রতিদিন সকাল ৭ টার সময় সম্মেলনের কাজ আরম্ভ হয়ে শেষ হত রাত ১০ টার
সময়।
সম্মেলনের শেষে সভাপতির ভাষণে জনাব
মিঃ জিন্নাহ সাহেব সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং এই সম্মেলনকে সফল করার জন্য সকল কর্ম
কর্তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। উক্ত সভায় ৩০ থেকে ৩২ টি প্রস্তাব পাশ করা হয়। সর্ব
সম্মতিক্রমে সেই প্রস্তাব গভর্নর-এর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
সভার আয়োজক জেনারেল সেক্রেটারি
ছিলেন আব্দুল বারি সাহেব। বারি সাহেব ছিলেন একজন বিখ্যাত আইনজ্ঞ মুর্শিদাবাদের
সাগরদিঘির ইসলামপুরের বাসিন্দা, অল্প বয়সে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতিদের দৃষ্টি
আকর্ষণ করেছিলেন, মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি যক্ষারোগে মারা যান। সেখ সাখাওয়াত হোসেন আল কাদেরী। ফাইন্যান্স সেক্রেটারি ছিলেন মৌলভী আব্দুল গণি সাহেব। ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ
সাদেক রেজা, মুর্শিদাবাদ ও আব্দুর রসিদ সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট ভাবতা- মরতুজা রেজা চৌধুরী এম এল এ জঙ্গীপুর, গোলাম মেহবুব তালিবপুর, আব্দুস সামাদ (খান বাহদুর)- যাঁর নামে
বহরমপুর গোরাবাজারে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। আরো স্থানীয় লোকেদের সাহায্যে
এই কর্মযজ্ঞ সুস্থভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
উল্লেখযোগ্য বিষয় তৎকালীন নবাব
পুত্র সৈয়দ কাজেম আলী মীর্জা (এম এল এ) সাহেব এই বিরাট কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে সাহায্য
করেছিলেন।
(তথ্যসূত্রঃ সেখ জেরাফত হোসেন,
গঙ্গাপুর, প্রাপ্ত ডাইরি থেকে)
আরও পড়ুন : মুর্শিদাবাদের নদনদী ও চাঁদ সওদাগরের যাত্রাপথ
আরও পড়ুন : মুর্শিদাবাদের নদনদী ও চাঁদ সওদাগরের যাত্রাপথ


No comments:
Post a Comment