শান্তনু দাস(পুরুলিয়া): কথায় আছে রথের রশিতে টান পড়বে আর জল হবে না.....? তা কোনদিনই হতেই পারে না।
প্রচলিত কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলাতে এবারও ঝেঁকে নেমে এলো জলের বেশ কয়েকটি ফোঁটা। বাদ পড়ল না জেলা পুরুলিয়াতেও। মঙ্গলে উষা, বুধে পা। সঙ্গে আবার শুভ রথযাত্রা।
প্রচলিত কথায় শোনা যায়,জগন্নাথ যান মাসির বাড়ি। কিন্তু এই মাসির বাড়ি আসলে কোথায়, আর কেই বা এই মাসি। সেই মাসি জগন্নাথের বান্ধবী ‘পৌর্ণমাসি’-র বাড়ির কথা বলা হয়েছে এখানে। সেখানে সাত দিন কাটিয়ে যখন জগন্নাথ মন্দিরে ফেরেন তখন তাঁর অভিমানী স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী তাঁকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেন না। পরে অবশ্য জগন্নাথ স্ত্রীর মানভঞ্জন করেন রসগোল্লা। তার পরে মেলে তাঁর মন্দিরে প্রবেশাধিকার। সেকাল থেকে একাল রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে সারা রাজ্য জুড়ে জেলায় জেলায় রথকে নিয়ে মানুষের উৎসাহ এতটুকুও কমেনি। আর এবারেও রাজ্যের সঙ্গে তাল মেলালো জেলা পুরুলিয়াও।
প্রতিবছরের মতো এবছরও পুরুলিয়া জেলার নানা প্রান্তে রথকে কেন্দ্র করে মেতে উঠলেন ভক্তবৃন্দরা। উদাহরণ স্বরূপ পুরুলিয়া জেলার মুন্নিবাই রথযাত্রা পুজা কমিটি, আদ্রা অগ্রদূত রথ কমিটি, আদ্রা জগন্নাথ মন্দির রথ কমিটি এবং কাশীপুর রাজবাড়ি রথযাত্রা পুজা কমিটি সহ বেশ কয়েকটি প্রান্তে। কিন্তু জেলার মধ্যে এসবের থেকেও একেবারে অন্যস্থান দখল করে নিয়েছে মুন্নিবাই রথযাত্রা পুজা কমিটি।
জগন্নাথ দেব, বলরাম দেব, সুভদ্রা দেবী নয়, এই রথে আরোহী হন রাধা-গোবিন্দের জোট। আর এই চিত্রটা হয়তো সর্বপ্রথম পুরুলিয়া জেলার এই মুন্নিবাই-এর রথেই ধরা দিয়ে আসছে আজ থেকে প্রায় 105 বছর ধরে। সেই কারণেই হয়তো আজও সারা জেলার মানুষের কাছে এই মুন্নিবাই-এর রথ একই রকমভাবে আকর্ষণীয়। মুন্নিবাই-এর রথের রশিতে টান শুধু জেলার মানুষের হাতের শক্তিতে নয়, বহু দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্তদের হাতের শক্তিতে এই রথের আগমন ঘটে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্য।
জানা যায়, পঞ্চাকোট রাজবংশের কোনও এক রাজার সময়ে রাজার মনোরঞ্জনের জন্য 1912 সালের কিছুদিন আগে লখনউ থেকে মুন্নিবাঈ ওরফে মনি বাঈজি এখানে এসেছিলেন। নিজের সৌন্দর্য এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে মন জয় করেন রাজ-পুরুষদের। পরবর্তীকালে তিনি কতিপয় ধর্মপ্রাণ মানুষের সংস্পর্শে এসে নিজের পেশা পরিত্যাগ করে বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং এখানেই তিনি থেকে যান। ধীরে ধীরে বৈষ্ণবীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে তিনি মনমোহিনী বৈষ্ণবী নামে পরিচিতি লাভ করেন এবং পুরুলিয়া শহরের প্রানকেন্দ্র চকবাজারে একটি মন্দির নির্মাণ করে রাধাগোবিন্দের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। আর তারপর থেকেই শুরু হয় এই রথযাত্রা। রথযাত্রা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তৎকালীন কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে মনোমোহিনী বৈষ্ণবী একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন।
সেই বোর্ডের বর্তমান সম্পাদক চোকবাজারের বাসিন্দা নন্দলাল দত্ত কইরার জানান -- 1922 সাল থেকে তাঁর পরিবারের বংশানুক্রমে তিনি আজ এই রথযাত্রার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পেরিয়ে গেছে যুগের পর যুগ। তবে এখন এই রথযাত্রা উৎসবের আঙ্গিকে আমূল পরিবর্তন এসেছে। পুরুলিয়ার এই রথযাত্রা এখনও জেলার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে রয়েই গেছে।


No comments:
Post a Comment