23 January 2017

সম্প্রীতির বন্ধনে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও মুর্শিদাবাদ

দীননাথ মণ্ডল
হলওয়েল মনুমেন্ট, কলকাতা (Holwell Monument, Kolkata), ছবি: ইন্টারনেট সংগ্রহ 

গুরু দেশবন্ধু সব সময় বলতেন-‘হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তি ছাড়া ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়’। গুরু চিত্তরঞ্জন দাশের বাণী বুকে নিয়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ছুটে বেড়িয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তাঁর ফরওয়ার্ড ব্লক দল প্রতিষ্ঠার (৩ মে, ১৯৩৯ সাল) পরই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। ভারতবাসীর সমর্থন পেতে তিনি নিজেই নেমে পড়লেন দলের প্রচার কাজে।
      ১৯৩৯ সালের জুন মাস। পা রাখলেন মুর্শিদাবাদ জেলার মাটিতে। বহরমপুর শহর। তখন গ্রীষ্মের ছুটি, সমস্ত স্কুল কলেজ বন্ধ। নেতাজির ভাবধারাকে ছাত্রদের কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হলেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ শ্রীযতীশ চন্দ্র মিত্র। ১৪ জুন সভার আয়োজন করলেন কৃষ্ণনাথ কলেজে। বার্তা গেল ছাত্রদের কাছে। প্রিয় দেশনেতাকে বরণ করার জন্য ছাত্ররা ছুটে এলো দলে দলে। ব্যান্ডবাদ্য বাজিয়ে পুষ্পবৃষ্টি ছিটিয়ে  বরণ করে নিলেন নেতাজিকে। কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নেতাজির হাতে তুলে দেওয়া হল খাগড়ার কাঁসার বাসনের উপর খোদাই করা কবিতা লেখা মানপত্র ও দলীয় তহবিলে প্রদান করা হল ৫১ টাকা। কবিতাটি লিখেছিলেন কলেজের ছাত্র ননী ভট্রাচার্য। নেতাজি এই সভায় বক্তৃতা রাখলেন প্রায় আড়াই ঘন্টা । কলেজের ছাত্ররা অভিভূত ও অনুপ্রাণিত নেতাজির কথা শুনে। এই সফরে তিনি ঘুরলেন জেলার বিভিন্ন শহরে। লালবাগের খোসবাগে গিয়ে মাল্যদান করলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সমাধিতে। দেখা করলেন বন্ধুপ্রতীম নবাব বাহাদুর ওয়াসেফ আলি মির্জার সঙ্গে।  উল্লেখ্য নবাব বাহাদুর ওয়াসেফ আলি মির্জা ১৯৩৭ সালে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সমিতি গঠন করে রাজ্যব্যাপী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। ১৯৩৮ সালে হাজারদুয়ারীর ময়দানে দু-দিন ধরে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সমিতির সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন তিনি। নেতাজি সভা করলেন লালবাগের জুবিলি হলে ও বেলডাঙাতেও। স্বচক্ষে দেখলেন মুর্শিদাবাদ জেলার হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ সম্প্রীতি ও ভালোবাসা।  

      কলকাতায় ফিরেই সিদ্ধান্ত নিলেন পলাশী দিবস উদযাপন করার। ওই বছর ২৩ জুন পলাশী দিবস পালিত হয় কলকাতায়। সঙ্গে ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং মওলানা আকরম খাঁ। এ ব্যাপারে কবি নজরুলের একটি বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছিল ‘দৈনিক আজাদ' এবং  ‘মাসিক মোহাম্মদী' পত্রিকায় ১৯৩৯ সালের ২৯ জুনে। বিবৃতিতে নজরুলের আহ্বান ছিল- ‘মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে কলিকাতায় সিরাজ-উদ-দৌলা স্মৃতি কমিটি উক্ত অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন। কলিকাতা কমিটিকে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদান করিয়া আমাদের জাতীয় বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিবার জন্য আমি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট আবেদন জানাইতেছি। বিদেশীর বন্ধন-শৃঙ্খল হইতে মুক্তি লাভের জন্য আজ আমরা সংগ্রামে রত। সিরাজের জীবনস্মৃতি হইতে যেন আমরা অনুপ্রাণিত হই। ইহাই আমার প্রার্থনা।‘ 
     এখানেই নেতাজি ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বাংলার হিন্দু মুসলিম সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে পরের বছর অর্থাৎ ৩রা জুলাই ১৯৪০ এ কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিলেন। উল্লেখ্য পলাশীর ষড়যন্ত্র যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার শোচনীয় পরাজয় ঘটলেও ইংরেজরা ক্ষান্ত হয়নি সেদিন তারা নবাবের চরিত্রে নানাভাবে কলঙ্কলেপন করতে থাকে - অন্ধকূপ হত্যা, লাম্পট্য ইত্যাদি মিথ্যা গল্প ফেঁদে সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে কলকাতায় একটা মনুমেন্ট তৈরী হয়েছিল তার নাম ছিল হলওয়েল মনুমেন্ট 
     বাংলা মুসলিম সমাজ নেতাজির সমর্থনে এলো। ২৯ জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক বিরাট জন সভার আয়োজন হল। সেখানে দাঁড়িয়ে নেতাজি বলেছিলেন, "হলওয়েল মনুমেন্ট জাতীয় পরাধীনতার অন্যতম চিহ্নস্বরূপ।  বহু বৎসর যাবৎ এই অলীক কলঙ্ক-চিহ্ন বাংলার বুকে দাঁড়াইয়া আছে।... এই বিষয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমান সকলেই একমত। তাই যখন এমন একটা বিষয় পাওয়া গিয়াছে, যাহা লইয়া বাঙালি মাত্রেই একমত তখন তাহা লইয়া আমাদের কার্য করিতে হইবে। ৩ রা জুলাই সিরাজ-উদ-দৌলার স্মৃতি-দিবসের মধ্যে হলওয়েল মনুমেন্টটি লোকচক্ষুর অন্তরালে সরাইয়া লইবার দাবী বাংলার সরকারের নিকট করা হইয়াছে। আমরা চাই জাতির মিথ্যা কলঙ্ক-স্বরূপ মনুমেন্টটি লোকচক্ষুর অন্তরালে সরাইয়া লওয়া হউক।" ওই দিনই ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকায় তিনি জানান- ‘আগামী ৩ জুলাই থেকে আমাদের অভিযান শুরু হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে প্রথম দিনের বাহিনী পরিচালনা করবো আমি নিজে।’
    হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংগ্রামের সংবাদে ভীত হয়ে প্রমাদ গুণলেন ইংরেজ সরকার। তারা থেমে না থেকে  শুরু করল ব্যাপক ধরপাকড়। ২ জুলাই নেতাজিকে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বন্দি করল ইংরেজ পুলিশ ভারত রক্ষা আইনের ১২০ ধারা মতে। রাখা হল প্রেসিডেন্সি জেলে। 
     নেতাজির গ্রেপ্তারের সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই সারা দেশ বিক্ষোভে উত্তাল। মর্মাহত চিত্তে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন থেকে এই নিন্দনীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রেস-বিবৃতি দিয়ে সুভাষচন্দ্রের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। ১৩ জুলাই জনাব আব্দুল করিমের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা হল সেই অ্যালবার্ট হলে। দলে দলে হিন্দু-মুসলমান যোগদান করলেন সভায়। প্রতিবাদ উঠল নেতাজির মুক্তি চাই, হলওয়েল মনুমেন্টের অপসরণ চাই। ইংরেজ সরকার জারি করল সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ, হলওয়েল মনুমেন্ট অপসরণ আন্দোলনের খবর যেন না ছাপে। হুঁশিয়ারী দেওয়া হল ছাত্র সমাজকে, তারা যেন কোন মিছিল মিটিং না করে। ফরওয়ার্ড ব্লক দলের সমর্থকদের ধরে জেলে নিয়ে যাওয়া হল। ইংরেজদের হুঙ্কারকে ভয় না করে সর্বাগ্রে এগিয়ে এল ইসলামিয়া কলেজের ছাত্ররা। কলেজ প্রাঙ্গনে তারা সমবেত হয়ে ইংরেজ সরকারের নীতির বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনে নামলেন। পুলিশ তাদের উপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করল। দাবানলে মতো এই আন্দোলনে আগুন  ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। বাংলা ছাত্র সমাজ মিছিল করে পথে নামল দলে দলে। আন্দোলনের চেহারা বেগতিক দেখে ১৯৪০ সালের ২৩ জুলাই  বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ঘোষণা করলেন, সরিয়ে নেওয়া হবে মনুমেন্ট। আন্দোলনরত জেলবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হল একে একে। কিন্তু আটকে রাখল নেতাজিকে। তখন বাধ্য হয়ে ২৯ নভেম্বর থেকে মুক্তির দাবীতে জেলখানায় অনশন শুরু করেন তিনি। ৭ দিন অনশন পালন করার পর মুক্তি দেওয়া হল তাঁকে। তবে তিনি তখনও পুলিশি নজরে ছিলেন।
     বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে  নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল ইংরেজরা। নবাব সিরাজের নামে মিথ্যা ও কলঙ্কের স্তম্ভ হলওয়েল মনুমেন্ট ডিসেম্বর মাসে, শহরের প্রাণকেন্দ্র ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে সরিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল সেন্ট জনস গির্জায়। জয় হল নেতাজির সুভাষ চন্দ্র বসুর। জয় হল হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ মিলিত শক্তির। 

    [ তথ্যসূত্রআমি সুভাষ বলছি' -শৈলেশ দে, মুর্শিদাবাদ জেলা গেজেটিয়ার ২০০৩', কথায় কথায় বহরমপুর' - কানাই পদ রায়, ইন্টারনেট ]    

No comments:

Post a Comment