13 April 2016

গাজনের আসরে হারানো সেদিনের সাজলে গান

চৈত্রের প্রায় শেষ। আসর ভর্তি দর্শক। বাজনার তালে তালে জমে উঠেছে রঙ-পাঁচালী। গ্রাম্য খেউর খিস্তির এই বিনোদন থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না। আসরে টোন-টিপ্পনি, হাসি-মস্করা চলছে। হঠাৎ করে আসর নিশ্চুপ হয়ে গেল। রঙ-পাঁচালীর দলপতি হতবাক। কেন এমন হল! উঠে দেখে
'ওরা' এসেছে। মুখে কালি, কপালে বড়ো করে সিঁদুর লেপা, কানে লাল পলা -- কাপালিকের সাজে জনা পাঁচেক লোক। প্রত্যেকের লাঠির আগায় পোটলা বাঁধা। ওদের সর্দারের হাতে লাল ন্যাকড়ায় বাঁধা মরার খুলি। দেরি না করে রঙ-পাঁচালীর দলপতি তড়িঘড়ি পাঁচালী শেষ করার নির্দেশ দিল। তা না হলে 'ওরা' এক তুড়িতেই বাজনা ফাঁসিয়ে দেবে, কণ্ঠের সুর কেড়ে নেবে। তাই মানে মানে আসর ছেড়ে দেওয়ায় ভালো। ঢাকের কাঠির 'কুড়-কুড়-কুড় ড্যাডাং ড্যাডাং’ শব্দে আসরে শুরু করল ওরা অন্য একটি পালা। মরার খুলি মাঝে রেখে তার চারপাশে গোল হয়ে বসে ঢাকের তালে তাল রেখে সমবেত ভাবে বলে-
  "ওরে সাজলে-
       কাল বাছা খেয়েছিল ঢুকুই ভরা মুড়ি
       আজ বাছার মুন্ডু যায় ধূলায় গড়াগড়ি।


আসর জুড়ে উদ্ভব ঘটে এক আধিভৌতিক পরিবেশের। সহসা তাদের সর্দার ন্যাকড়া জড়ানো মরার খুলি মুখে নিয়ে ঘুরে ঘুরে আসরের মাঝে নাচতে থাকে, সাঙ্গোপাঙ্গোরা গেয়ে চলে-
   "ওরে সাজলে-
         জল শুদ্ধ স্থল শুদ্ধ শুদ্ধ তামার বাটি
         আড়াই হাত মৃত্তিকা শুদ্ধ শুদ্ধ ঢাকের কাঠি।"

শ্মশানবাসী শিবের তন্ত্রমন্ত্রকে কেন্দ্র করে গাজন উৎসবের সময় সাজলে নামক এই মরার খুলির খেলার উদ্ভব ঘটেছিল মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদীয়ার গাজনের আসরে আসরে। তন্ত্র সাধনার সঙ্গে জড়িত গোটা কয়েক মানুষ সাজলে নামক গান গেয়ে বেড়াত। কালক্রমে আধুনিকতার স্পর্শে তন্ত্রমন্ত্র ধারণা ফিকে হতে থাকে জনমানস থেকে। কর্পূরের মতো উবে যায় সাজলে গান নতুন প্রজন্ম সাজলে পালার ওই পৈশাচিক আনন্দকে বুকে নিয়ে আসরে আসরে গান গেয়ে বেড়ানোর তাগিদ অনুভব করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। চৈত্রের গাজনের আসর থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে সাজলে গান।  বাংলার লোকসংস্কৃতির গবেষণার পাতায় কোন এক কোণে শুধুমাত্র একটু জায়গা করে নিয়েছে এই সাজলে গান

No comments:

Post a Comment