নিজামুদ্দিন সেখ
![]() |
| গোরুর গাড়ির চাকা তৈরির কাজ চলছে। |
ছেলেবেলায় আমরা রবি ঠাকুরের “কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি/ বোঝায়
করা কলশি হাঁড়ি’’– ছড়াটি সকলে পড়েছি। এক সময় গ্রামীন
জনজীবনের যাতায়াত ও মাল বয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল উপায় ছিল গোরুর গাড়ি। কিন্তু সে আজ
অতীতকথা। সলতি নেভা ধোঁয়ার গন্ধ বুকে করে আজও দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন রেজিনগর
থানার দাদপুরের গোরুর গাড়ির চাকা শিল্প।
স্থানটা অনেকের পরিচিত থাকতে পারে, ৩৪নং জাতীয় সড়ক দাদপুর আমবাগান মোড় থেকে পশ্চিমদিকে ৫০০ মিটার দূরে দাদপুর ছুতুরপাড়া। এক সময় কান পাতলে শোনা যেত কাঠ ঘসার খস-খস আর হাতুরি ঠোঁকার ঠক-ঠক শব্দ। এই আওয়াজই জানান দিত ছুতুর পাড়া এসে গেছে। ১০০ বছরেরও প্রাচীন এখানকার চাকা শিল্প। স্মৄতি রোমন্থন করতে গিয়ে আশিস মিস্ত্রি (৬০) জানালেন, তাদের বংশ পরম্পরা ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের কথা- “আমরা চারপুরুষ ধরে চাকা তৈরি করে চলেছি, আমার পূর্বপুরুষরা হলেন রামদাস মিস্ত্রি তার পুত্র শ্যাম দাস মিস্ত্রি তার পুত্র দশরথ মিস্ত্রি আর আমি তার পুত্র আশিষ মিস্ত্রি”। একটা সময় শুধু মুর্শিদাবাদ নয় পাশের জেলা নদিয়া, বীরভুম, বর্ধমান থেকে লোক আসত চাকা নেওয়ার জন্য। ৩১টি কাঠ বিশিষ্ট চাকার মধ্যে থাকে লাহা ১টি, স্পোক ৬টি, চুল ৬টি, পুটি ৬টি, পজরা ১২টি। লাহার আঁট বাঁধুনি ছিল এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। চাকা ছিল হাল্কা। ফলে গাড়ির গতি তুলনামূলকভাবে বেশী থাকত। চাকার মাথায় লাগানো থাকত বিশেষ লোহার রিং যা হাল নামে পরিচিত, মাঠের গভীর কাদা ভেদ করার ক্ষমতা রাখে। শাল, শিশু আর বাবলা কাঠের সমন্বয় দিয়ে তৈরি চাকা আকর্ষণ করত চাষির মন। কিন্তু এখন সেই শব্দ বিলিয়মান। চল্লিশ ঘর মিস্ত্রির মাত্র ২ জন সেন্টু মিস্ত্রি আর খেদু মিস্ত্রি, এরা বছরে এক-আধটা বরাত পান। কেউ আবার এখন স্মৃতির পাতায়। অন্যরা বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছে। অনেকে আবার পেশা গ্রহণ করতে পারেননি এখনো।
দিলিপ মিস্ত্রি জানালেন-“আমার সরকারি রেজিস্টেশন আছে। আগে
কিছু অনুদান পেতাম। কিন্তু এখন তাও মেলে না। সংসারের অর্থাভাব তাড়া
করে চলেছে আমাকে।”
সময় সঙ্গ দিয়েছে সভ্যতাকে এগিয়ে দিতে উন্নতির চরম শিখরে। যন্ত্র
শিল্পের কল্যাণে বাজারে এসে গেছে ট্রাক্টার। ফলে জমি চাষ থেকে ঘরের
লক্ষ্মী ঘরে আনা সবেতেই মাঠের বুক চিরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই যন্ত্রদানব। তাই ডাক
পান না গড়িয়াল ভাই বংশিবদনরা। চাষির খামারে গোরুর গাড়ির চাঁদ বদনের দেখা পাওয়া ভার। গাড়িই
যেখানে নেই চাকা কি হবে। তাই কালের নিয়মে চাষির পবিত্র চরণ থেকে বঞ্চিত
হচ্ছে ছুতুর পাড়ার মাটিও।


No comments:
Post a Comment