প্রতিবেদনঃ✒ কাজীনূর জগতশেঠ : এখনো স্কুলের পাঠ্যপুস্তক শুকলে মুর্শিদাবাদ জেলার যাবতীয় গুরুত্ব ভেসে আসে। পুস্তকগুলির সূত্র ধরে 'বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যা'র রাজধানী হিসাবে মুর্শিদাবাদ এর নাম আজো সবার মুখে মুখে। অবশ্য নবাব গেছে সেদিনই জেলার নবাবি ধুলিসাৎ হয়েছে। সবটাই ইতিহাস এখন। জেলার মান-মর্যাদা বলে কিছু অবশিষ্ট রয়েছে বলে মনে হয় না। তবে জেলার কিছু ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র থাকায় হয়ত রাজ্যবাসী তথা সমগ্র ভারতীয়দের মনে উঁকি দেয় জেলার নাম। মুর্শিদাবাদ নেই আর মুর্শিদাবাদে। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে জেলা তার মান হারিয়ে পরিচিত হয়েছে ভিন্ন নামে। কখনো তা 'লালদূর্গ' কখনো বা 'অধীরদূর্গ' কিংবা 'দিদির স্বর্গধাম'।
প্রকাশ থাকে যে, মুর্শিদাবাদ জেলা স্বাধীনতার সত্তর বছর পার করেও তার অধিকার থেকে বঞ্চিত। সে বাম জামানায় হোক কিংবা কংগ্রেস জামানায়। সাম্প্রতিককালে তৃণমূল কংগ্রেস তথা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে যখন সমগ্র রাজ্যজুড়ে উন্নয়ন জোয়ার চলছে, সেখানে মুর্শিদাবাদ জেলা সেদিনের মতোই ব্রাত্য। রাজধানী মুর্শিদাবাদ জাতির গর্ব। একদিন এই রাজধানী শহরকে কেন্দ্র করেই সমগ্র বাংলা তথা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল। অথচ অত্যন্ত শোচনীয় বিষয় যে, সেখানে আজ অবধি একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলো না। আশি লক্ষ মানুষের জন্মদাত্রীকে নিয়ে আজ অবধি কোনো সরকারকেই তেমন জনমুখী কর্মসূচীগ্রহণ করতে দেখা যায়নি, এমনকি জেলার শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘঠাতে কোনো সরকার এগিয়ে আসেনি। অবাক হওয়ার বিষয় যে, আজ জেলার মানুষকে ঘনঘন মিটিং মিছিল করতে হয়, জেলায় একটি পূর্নাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবীতে। আশ্চর্যজনক ঘটনা এই যে, স্বাধীনোত্তর বাংলার কোনো নেতা-মন্ত্রীকে এই নিয়ে উচ্চ-বাচ্য করতে দেখা গেল না। এমনকি যারা জেলা থেকে নির্বাচিত হয়ে লোকসভা কিংবা বিধানসভায় গিয়ে টেবিল থাপড়াথাপড়ি করেন তারাও।
'মুর্শিদাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় চাই' এই শ্লোগান আজকের নয়। একবিংশ শতকের শেষ দশকে এই নিয়ে মাঝে মাঝে দু-চার কথা শোনা যেত। অত:পর জেলার পত্র-পত্রিকায় এই দাবী জোরালো হতে থাকে। অধুনা ২০০৭ সালের পর থেকে তা কাগজ কলম থেকে আন্দোলনের রূপ নেয়। আজকে জেলার ঘরে বাইরে এই শ্লোগান মুখরিত হতে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে প্রায়শ এই নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলি এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়ে ওঠেনি। উল্লেখ্য যে, জেলাবাসী আজকাল বড়ই দিদিপাগল। আর দিদির আগমনে এরা আনন্দে আটখানা হয়ে ওঠে। দিদি এসেছেন একবার-দুবার নয়, বেশ কয়েকবার। সকলেই আশায় বুক বাঁধেন কিন্তু ফল সেই তলানিতেই। আজো মুখ্যমন্ত্রীর মুখে মুর্শিদাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু বলতে শোনা যায়নি। যেখানে আজ অবধি ৪৬ টি কলেজ ও ১৭ খানা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় দণ্ডায়মান। অতি সম্প্রতি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মশাই ঘোষনা করলেন, এই রাজ্যে শিক্ষার মানোন্নয়নে আরো তিনটি (ঝাড়্গ্রাম,হুগলি,মেদিনীপুর) বিশ্ববিদ্যালয় গড়া তোলা হবে। গড়পড়তাভভাবে মুর্শিদাবাদের নাম পূর্বের মতোই এড়িয়ে গেল। জেলাবাসীর পাওনা শুধু বৈমাতৃসুলভ ব্যবহার। পিছিয়ে পড়া শ্রেণি তো আর এমনি এমনি হয়নি।
মুর্শিদাবাদ জেলা সূত্র থেকে জানা যায়, জেলাতে বর্তমানে প্রায় ৬৮% শতাংশ মুসলিম বসবাস করে। জেলা হিসাবে মুর্শিদাবাদ সারা ভারতবর্ষের মধ্যে একটি অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া এক জেলা। এখানকার অধিকাংশ মানুষই সাধারণত বিড়িশ্রমিক, রাজমিস্ত্রী, ছুতর, দিনমজুর হিসাবেই জীবন অতিবাহিত করে থাকে। যৎসামান্য মধ্যবিত্ত পরিবারের দেখা মিললেও অধিকাংশ পরিবার দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। চাকরি-বাকরি নেই বললেই চলে। আনন্দের বিষয়, এই সমস্ত পরিবার গুলো থেকেই প্রতিবছর হাজার হাজার ছেলে স্নাতক ডিগ্রীলাভ করছে। এদের উঠে আসার পিছনে সরকার প্রাইমারী থেকে স্নাতকস্তর পর্যন্ত ঢাকঢোল পেটালেও পরবর্তী ধাপে ভর্তির সুযোগ পর্যন্ত করে দেয়নি। মাধ্যমিক লেবেল থেকে স্কুলছুটের যে গতিধারা তা স্নাতক স্তরে সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে। স্নাতকোত্তরে ভর্তি হবার ইচ্ছে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে সেই স্বপ্ন অচিরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ব্যতিক্রমী কয়েকজন ছাত্রছাত্রী উচ্চডিগ্রীর আশায় পার্শ্ববর্তী নদীয়া জেলা ও এদিক-সেদিক পাড়ি দিয়ে থাকলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীর কাছে তা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সেহেতু তারা মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আমরা অনেকেই অবগত যে, জেলার অধিকাংশ পড়ুয়ারা স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ই তাদের পরিবারকে টানতে শুরু করে দেয়। দিতে থাকে অর্থনৈতিক যোগান। শুরু হয় পড়াশুনার ফাকে ফাকে দিনমজুর, রাজমিস্ত্রী ও বিড়ি বাধাইয়ের কাজ। কিন্ত স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য পড়াশুনার জন্য দুরবর্তী স্থানে গমন করা মানেই তাদের পরিবারের পেটে লাথি মারা। আর এই ভয়ে তারা জেলার চৌকাঠ পার করতে কুণ্ঠাবোধ করে। আর এখানেই সমস্ত জল্পনাকল্পনারর সমাপ্তি। চাকরি পাওয়া তো দূর অস্ত।
শুধু মুসলিম বলে কথা নয়। এই জেলাতে শিক্ষিতের হার ৬৬.৫৯ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও একটি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকা জাতির কাছে লজ্জার বিষয়। যেখানে ৮০ লক্ষ মানুষ বসবাস করে সেখানে উচ্চশিক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাটাও সরকারপক্ষের অপদার্থতা প্রমাণ করে। অথচ আরটিই অ্যাক্ট বলছে, ১০ লক্ষ জনসংখ্যা পিছু একটি বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্যতামূলক। তাই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য কেউ আন্দোলন করুক কিংবা জোরালো দাবী, মুর্শিদাবাদ জেলাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় না গড়তে পারাটাও সেই সরকারের কাছে চরম লজ্জার বিষয়। সরকারপক্ষ তাতে যতই হামবড়াই করুক না কেন।
মুর্শিদাবাদ জেলাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই নিয়ে রাজনীতি করা পক্ষ-বিপক্ষ সবার কাছেই ক্ষতিকারক হবে বলেই মনে করছি। সবকিছু অতীত ও ঐতিহ্যের মোড়কে না রেখে বাস্তববোধকে কাজে লাগানো উচিৎ। কেননা, বর্তমান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে রাজ্যের মুসলিম সমাজের কাছে নয়নের মনি হয়ে বিরাজ করছেন, তার যথাযথ সুযোগ নেওয়াটাও যেমন জরুরি, সুযোগ করে দেওয়াটাও অত্যন্ত বেশি জরুরি। মুর্শিদাবাদ জেলায় যদিও মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবুও তারা সম্প্রীতির আদর্শে চলাফেরা করে। এদের দাবী কখনোই অন্যায্য ছিল না, এখনো নেই। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী নিয়ে তারা যে সমান্তরাল আন্দোলন করছে, এতে রাজ্য সরকারের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। কেননা জেলার বিশ্ববিদ্যালয় জেলাবাসীর অধিকার। সুতরাং সরকারপক্ষের শুভ চিন্তক হিসেবে পরামর্শ বলা যেতে পারে, মুর্শিদাবাদ জেলাবাসীকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে জেলাকে চিরদিনের মতোই হাত করে রাখা খুব সহজ হবে। কেননা আপনারা নিশ্চয় জানেন, রাজ্যে কংগ্রেস দল ধরাশায়ী হলেও, এখনো মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস দলের সভাগুলিতে দর্শক-শ্রোতা ঠাসাঠাসি করে। বিগত কয়েকদিন আগে শুভেন্দবাবু তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। মুর্শিদাবাদকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঞ্চিত করা মানেই সারারাজ্যে মুসলিম মোল্লাদের নিয়ে মাতামাতি করুন না কেন, সব মোল্লায় কিন্তু মুর্শিদাবাদের জল খেয়ে মানুষ। সুতরাং বুমেরাং কিছু যে ঘটবে না তা কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে না। ভাতা দিয়ে বেশিদিন চলবে বলে মনে হয় না। মুসলিমরা ভাতা নয়, ভাত চাই। আর সরকার পক্ষের উচিৎ হবে সকলকে সমান নজরে দেখে এদের জন্যও সঠিক ও সম্মানীয় অর্থের যোগানের ব্যবস্থা করা। আপনারা খোজ নিয়ে দেখুন, মুর্শিদাবাদের চাকরি-বাকরির হাল হকিকত। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার যারা স্নাতকোত্তর লেখাপড়ায় বঞ্চিত হয়ে দিশেহারা তারা কিন্তু বসে নেই কেউই। তারা সংগঠিত হতে শুরু করেছে। জেলাবাসী তথা মুসলিমদের কেবল কারখানার শ্রমিকের যোগানদাতা মনে করাটা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে। অশনিসংকেত দেখা দিচ্ছে কিন্তু। কাঁসার শিল্প, বিড়ি শিল্প, বেলডাঙ্গার গরুর হাটে হাব নির্মাণ এবং বেলডাঙ্গার সুগার মিলের গল্প না শুনিয়ে জেলার জন্য বাস্তবমুখী ও আধুনিক কর্মসূচি গ্রহণ করলে সরকার পক্ষের কাছে বেশি মঙ্গলজনক বলে মনে হয়। নচেৎ 'দিদির স্বর্গধাম' 'বাস্তিল দুর্গে' পরিনত হতে আর কতক্ষণ!


No comments:
Post a Comment